শুকাচ্ছে তিস্তা, সংকটে সেচ

দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজে পানি মৌসুমের শুরুতেই তলানিতে। ছবি

তিস্তা নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন চার হাজার কিউসেক পানি; কিন্তু চলতি মৌসুমে পাওয়া যাচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ কিউসেক পানি। এর ফলে সহজে অনুমান করা যায় নদীটি মরে গেছে।

তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প সূত্র জানায়, সেচ এবং নদীর প্রবাহমাত্রা ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে স্বাভাবিক প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি। শুধু সেচ প্রকল্প চালাতে প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ১৪ হাজার কিউসেক। কিন্তু তিস্তায় প্রয়োজনীয় পানি মিলছে না। অন্যদিকে ব্যারাজের সব জলকপাট বন্ধ রেখে সেচ প্রকল্পে পানি সরবরাহ করায় ভাটিতে তিস্তায় আর প্রবাহ থাকছে না।

এ কারণে ভয়াবহ পানিসংকটে পড়েছে তিস্তা। পানিস্বল্পতার কারণে রংপুর ও দিনাজপুরের পাঁচটি উপজেলাকে বাদ রেখে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে এ দুই জেলায় প্রায় অর্ধলাখ হেক্টর জমি সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই কৃষকদের বাড়তি ব?্যয় হবে ৬৫ কোটি টাকারও বেশি।

২০১৪ সালে বোরো মৌসুমে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু সেচ দেওয়া হয় ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সেচ দেওয়া হয় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৭ সালে মাত্র আট হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে তা বেড়ে ৪০ হাজার হেক্টরে দাঁড়ায়।

চলতি বোরো মৌসুমে দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। সেচ কমান্ড এলাকায় ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদানের কথা থাকলেও এ বছর সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মাত্র ৩৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। গত ২৭ জানুয়ারি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার গঞ্জিপুর এলাকায় এস-৩ আর ক্যানেলে সেচ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ। এ সময় সেচ প্রকল্পের ৭৮টি গেটের অপারেটের এবং পানি ব্যবস্থাপনা ফেডারেশনের কৃষক সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

পাউবো সূত্রে জানা যায়, সপ্তাহ দুয়েক আগেও ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ ছিল দুই হাজার কিউসেক। বর্তমানে তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড পরিমাণ কমেছে। ফলে ব্যারাজের ভাটিতে তিস্তা নদী এখন ধু ধু বালুচরে পরিণত হচ্ছে। চলতি বোরো মৌসুমে রংপুর ও নীলফামারী জেলার ৩৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি সেচের আওতায় নেওয়া হয়েছে। তিস্তার সেচ কমান্ড এলাকার প্রায় দুই লাখ কৃষক এই সেচের সুবিধা পাবেন। দিনাজপুর ও রংপুরের কমান্ড এলাকার প্রায় অর্ধলাখ হেক্টর জমি সেচ কার্যক্রম থেকে বাদ দিয়ে শুধু নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, সদর, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর, রংপুরের তারাগঞ্জ ও গঙ্গাচড়া উপজেলাকে রাখা হয়েছে। যদিও রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার ১২ উপজেলায় সেচ দেওয়ার কথা। তবে উজানের প্রবাহ পাওয়া গেলে সেচের জমির পরিমাণ রংপুর ও দিনাজপুরে বাড়ানো যেতে পারে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

অন্যদিকে তিস্তা অববাহিকার পাঁচ হাজার ৪২৭টি গ্রামের মানুষ তাদের জীবিকার জন্য এই নদীর ওপর নির্ভরশীল। তাই তিস্তার পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় এখানকার মানুষের জীবন ও জীবিকায় নেমে এসেছে চরম অনিশ্চয়তা। তিস্তা অববাহিকার আট হাজার ৫১ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। আর সমতল ভূমিতে তিস্তা অববাহিকার পরিমাণ চার হাজার ১০৮ বর্গকিলোমিটার। যার প্রায় অর্ধেক অংশ পড়েছে বাংলাদেশের সীমানায়। দুই দেশই তিস্তার পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সময় নদীর ওপর ও আশপাশে ব্যাপক অবকাঠামো তৈরি করেছে। ভারত এই মুহূর্তে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ কার্যক্রমের জন্য তিস্তার পানি ব্যবহার করছে। আর বাংলাদেশ তিস্তার পানি ব্যবহার করছে শুধু পরিকল্পিত সেচ দেওয়ার কাজে। কিন্তু গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে ভারতের একচেটিয়া পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি ক্রমাগত কমে গেছে। তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল এলাকাগুলোকে সেচের আওতার বাইরে রাখায় কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

তিস্তা পানি ব্যবস্থাপনা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান জানান, পানিস্বল্পতার কারণে কমান্ড এলাকার পুরোটাতে সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে এখন বড় সমস্যা হচ্ছে সেচ খালগুলো। দীর্ঘদিন থেকে খালগুলো সংস্কার না করায় এগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে খালগুলো সংস্কার করা দরকার।

তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউল বারী জানান, এবার ৩৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পানিপ্রবাহ বাড়লে সেচের আওতা বাড়ানো হবে।

 

 

 

 

 

 

আপনি আরও পড়তে পারেন